মানব বাবুর জমিদার বাড়ি এক ঐতিহাসিক নিদর্শন

0

দেশে-বিদেশে যেখানেই যাই অভ্যাসবশত জানার চেষ্টা করি সেখানে দর্শনীয় বা ঐতিহাসিক মূল্য বহন করে এমন স্থাপনা আছে কিনা। খোঁজ পেলে সেসব দেখতে ছুটে যাই।

সম্প্রতি অফিসের কাজে কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ির কথা। জমিদার বংশের বর্তমান উত্তরাধিকারী মানবেন্দ্র চক্রবর্তী চৌধুরীর নামানুসারে স্থানীয়রা এই বাড়িকে মানব বাবুর বাড়ি বলেও সম্বোধন করেন। মানব বাবু এই বংশের শেষ জমিদার ভূপতি চক্রবর্তীর সন্তান।

জানা যায়, এই জমিদার বংশের আদি বাসস্থান ছিল ভারতের কাইন্নাকব্জিতে। প্রায় ৬০০ বছর আগে তারা হোসেনপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে দীননাথ চক্রবর্তী হোসেনশাহী পরগনার অংশবিশেষ নীলকর এবং ওয়াইজের কাছ থেকে ক্রয় করার মধ্য দিয়ে জমিদারিত্ব শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে তাদের জমিদারিত্ব শুরু হয়, দেশ ভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই জমিদারিত্ব শেষ হয়।

প্রায় ১০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত গঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি। বাড়িটির নির্মাণশৈলীর সঙ্গে গ্রীক স্থাপত্যরীতির মিল রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলাধীন গোবিন্দপুর ইউনিয়নে এই বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন ভোলানাথ চক্রবর্তী। বাড়িটির ঐতিহাসিক মূল্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। একাত্তরে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মানববাবুর বাবা ভূপতি চক্রবর্তীসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যকে হত্য করে। দেশ স্বাধীন হলে জমিদার বাড়ির সদস্যরা ভারতে চলে যান। স্ত্রীকে নিয়ে দেশেই থেকে যান মানব বাবু। বাড়িটি অনেক যত্নে রেখেছেন মানব বাবু।

জমিদার বাড়িটি দেখতে শুক্র ও শনিবারে বেশি মানুষের ভিড় হয়। অনেকেই শুধু বাইরে থেকে দেখে চলে যান। কারণ মানব বাবু সাধারণত শুক্রবারে দর্শনার্থীদেরকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেন। সৌভাগ্যক্রমে শুক্রবারে গিয়েছিলাম। আমরা তিনজন গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। মানব বাবু আমাদের স্বাগত জানালেন। বাড়ির প্রবেশ পথে সংস্কৃতি ভাষায় লেখা ‘স্বাগতম’।

গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িতে ঢুকতে গেলেই চোখে পড়ে কয়েকটি মঠ। জানা গেল মঠগুলো মানব বাবুব বাবার এবং তাদের আরও কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের। সুবিশাল এই বাড়িটিতে রয়েছে অট্টালিকা, দরবার, নহবতখানা, বৈঠকখানা, অতিথি কক্ষ, সঙ্গীতচর্চা কক্ষ, মন্দির। বাড়িতে আরও রয়েছে সুবিশাল পুকুর। বাগানে নানা রকম ফল ও ফুলের গাছ।

এসব কিছু দেখে মুগ্ধ হতে হয়। শুধু তাই না মুগ্ধ করেছে মানব বাবুর আতিথেয়তাও। মানব বাবুর চালচলন, কথা বার্তা, আপ্যায়ন কৌশলে জমিদারি ছাপ লক্ষ্যণীয়। নানা রকম ফলমূল, মিষ্টি দিয়ে নাস্তা দিলেন। বাড়ি সম্পর্কে জানালেন নানা তথ্য। তার ব্যক্তিগত দুঃখের কথাও শোনালেন। মানব বাবুর বয়স নব্বই পেরিয়েছে। তিনি নিঃসন্তান। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি মূলত একা। এই জমিদার বাড়িতে দূরের মানুষদেরকেই আপন করে দিনযাপন করেন তিনি। মানব দরদী হিসেবেও এলাকায় তার খ্যাতি আছে।

নিজেদের জমিদারি থাকাকালে মানব বাবু কোলকাতায় পড়ালেখা করেছেন। শখের বশে ঐ শহরেই কিছুদিন চাকরি করেছিলেন। এরপর বাবার জমিদারি দেখভালের জন্য হোসেনপুরে চলে আসতে হয়েছিলো। দেশভাগের পর জমিদারি চলে গেলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখভালে মনোযোগ দেন। এখনও মানব বাবুর বিশাল, বিশাল মাছের ঘের রয়েছে। তাছাড়া উনি এখনও অনেক জমির মালিক। স্থানীয় সামজিক প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মন্দির, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানব বাবুর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।

জমিদারিত্ব চলে যাওয়াটা তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। জমিদারি থাকাকালে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন মাছের ঘের কেন্দ্র করে কোল্ড স্টোরেজ, ফিস প্রোসেসিং ব্যবস্থা আর এয়ার স্ট্রিপ করার। ভাবতেন এখান থেকে মাছ পাঠাবেন ইউরোপ, আমেরিকায়।

কথা বলতে বলতে মানব বাবুর চোখ যেন দূর-অতীত দেখতে পান। এই বংশের শেষ জমিদারের ছেলে হিসেবে নিজেকেই একমাত্র জীবন্ত জমিদার মনে করেন তিনি।

মানব বাবুর বাড়িতে প্রতিদিনের মতো সেদিন সন্ধ্যায়ও গানের আসর বসার কথা ছিল। তিনি আমাদের খুব করে বলেছিলেন গানের আসরে থাকতে আর রাতের খাবার খেয়ে আসতে। অফিসের কাজের জন্যই তাড়াতাড়ি কিশোরগঞ্জে ফিরতে হলো। সন্ধ্যার আগেই গাড়ি নিয়ে ছুটতে হলো অফিসের উদ্দেশ্যে। ফিরে আসার সময় তার বলা কথা কানে প্রতিধ্বনি হতে থাকলো, মানব বাবুর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই এই বংশের সর্বশেষ বাতিটি নিভে যাবে, জমিদারহীন হয়ে পড়বে জমিদার বাড়িটি।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.