প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিস্ময়ের নাম সুন্দরবন

0

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিস্ময়ের বাস্তব গল্পের নাম সুন্দরবন। প্রকৃতির অকৃপণ হাতের সৃষ্টি এটি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এ ম্যানগ্রোভ বনে বেড়াতে আসা যে কারও মন কাড়ে বিচিত্র উদ্ভিদের সবুজ সমরোহ। সেই সঙ্গে নদ-নদীর বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা খালে মাছ-কুমিরের খেলা, বনের গহীনে বাঘ-হরিণের দৌড়াদৌড়ির চিত্র সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে আরও বেশি ফুটিয়ে তোলে।

প্রায় ৬ হাজার ৫১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন রাত-দিন মিলে একাধিকবার নিজের রূপ বদলায়। ভোরে এই বন দেখতে এক রকম, আবার দুপুরে তার রূপ অন্য রকম। পরন্ত বিকেলে সুন্দরবন থাকে আরেক রূপে। রাতে সুন্দরবন শান্ত কোমল সুরে ভেসে আসে জোনাকি আর ঝিঁঝি পোকার শব্দ। ভাটায় পলি পড়ে স্থলভাগে এঁকে দেয় পদচিহ্ন, জোয়ারে সিক্ত করে বৃক্ষের প্রতিটি প্রান্তর।

সুন্দরবনের খালের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা লঞ্চের পেছনে উড়ে বেড়ায় সাদা বক, সি ঈগল ও গাংচিল। চোখের সামনেই খালের ভেতর থেকে ছো দিয়ে মাছ ধরে নিয়ে যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা। আকাশে ফিঙে, কাঠঠোকরার উড়ে বেড়ানো মনে এনে দেয় রাজ্যের প্রশান্তি। বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা সচারাচর না মিললেও বনের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। এছাড়া উন্মুক্ত স্থানে চিত্রল হরিণ, বনমোরগ ও হরেক রকম বানরের ছোটাছুটি মন জিতে নেয়।

সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি মানুষকে নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। হাজার হাজার সুন্দরী, কেওড়া, গরান, বাইন, গেওয়া, পশুর, গোলপাতা, হেতাল, কাঁকড়া, ঝানা, সিংড়া ইত্যাদি গাছ দিয়ে প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া সুন্দরবনের এই অপরূপ সৌন্দর্য। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এই ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন রয়েছে বনের অসংখ্য যায়গায়।

 

সামুদ্রিক ঝড়ের সময় বাংলাদেশের রক্ষাকবচ সুন্দরবন

খুলনা রুপসা নদী থেকে লঞ্চে উঠে জোয়ার ভাটার দিক নির্দেশনায় পশুর নদী দিয়ে উঠে ছুটে চলা সুন্দরবনের পথে। চলতি পথের দুই ধারে যেনে লঞ্চের সঙ্গে ভেসে চলে প্রকৃতি। স্যালা নদী হয়ে আন্ধারমানিক নদীতে গিয়ে রাত্রিযাপন। এরপর হোমরা খাল বেয়ে পৌঁছে গেলাম কটকা। সেখান হতে জামতলা সি বিচ, কটকা অফিস পার, কচিখালি, ডিমের চর, করমজল। প্রতিটি স্পটের সৌন্দর্যই আলাদা।

গাজীপুর প্রতিনিধি বলেন, আমরা প্রথম দিন সকাল ৮দিকে খুলনার রূপসা ঘাট থেকে লঞ্চে করে যাত্রা শুরু করি। লঞ্চটি মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর আগে চোখে পড়ে খুলনা শিপ ইর্য়াড ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুপুর আমরা চাঁদপাই ফরেস্ট অফিস পৌছে যাই। সেখানে বন-বিভাগের অনুমোদনপত্র ও গার্ড নিয়ে আমরা হাড়বাড়িয়া ইকো-পর্যটন কেন্দ্র/আন্ধারমানিক পৌঁছে যাই। দুপুরের লাঞ্চ করে আমরা জাহাজ থেকে নেমে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত হাড়বাড়িয়া ইকো-পর্যটন কেন্দ্র/আন্ধারমানিক ঘুরে দেখা শেষ করি। বিকেলে কটকা অভয়ারণ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে আমাদের লঞ্চ। রাত আনুমানিক ১টার দিকে পৌঁছে কটকা পৌঁছায় আমাদের লঞ্চ। সবাই লঞ্চেই রাত কাটাই।

 

সুন্দরবনে দেখা মেলে বিভিন্ন রঙের প্রজাপতির

ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন সকালে খুব ভোরে আমরা কান্ট্রি বোটে করে কটকার আশেপাশে ক্যানেল ক্রুজিং করে কটকা ওয়াচ টাওয়ার হয়ে গহীন বনের মধ্যে প্রবেশ করি। পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাই জামতলা সমুদ্র সৈকতের দিকে। চলার পথে বিভিন্ন রঙের অজস্র প্রজাপতির দেখা মেলে। প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার পায়ে হাটা পথে দেখা মেলে হরিণ, মৌচাক, বানরসহ বিভিন্ন পাখিদের সঙ্গে। জামতলা সমুদ্র সৈকত সুন্দরবনের অন্যতম সৌন্দর্য। এখানে কুয়াকাটার মতো স্পষ্ট সূর্যদয় দেখা যায়। সৈকতটিতে কক্সবাজারের মতো ঢেউ এসে আচরে পড়ে।

জামতলা সৈকত থেকে কটকা অফিসপাড়য় আসি। এখানে মূলত অজস্র হরিণ আর শুকুরের দেখা পাওয়া যায়। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কটকা ছেড়ে আমরা কচিখালীর দিকে রওনা দেই। দুপুর ১টা নাগাদ কচিখালী পৌঁছে যাই। কচিখালি গিয়ে ছুটে চলা ডিমের চরে। এটি মূলত একটি চর যার চারপাশে পানি। চরের মাঝে ঘনসাদা কাশফুল। এখানে গোসল, ফুটবল খেলার জন্য উপযুক্ত যায়গা।  সেখান থেকে দুপুরের পর ছুটে চলি কচিখালি অফিস পার্ক, সেখানে আমরা ক্যানেল ক্রুজিং ও ঘুরাঘুরি শেষ করে সন্ধ্যায় চলে আসি লঞ্চে।

 

লঞ্চ ও জাহাজে খুলনা থেকে সুন্দরবনে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় 

সারারাত লঞ্চে আড্ডা ঘুম শেষে তৃতীয় দিন সকালে গন্তব্যস্থল করমজল ইকো ট্যুরিজম সেন্টার। পশুর নদীর তীরে ৩০ হেক্টর জমির ওপর বন বিভাগের আকর্ষণীয় এক পর্যটনস্থল করমজলের মূল আকর্ষণ হলো হরিণ, কুমির, বানর, কাঠের ট্রেইল, টাওয়ার। এই কেন্দ্রটি দেশে প্রাকৃতিকভাবে কুমির প্রজননের একমাত্র কেন্দ্র। পর্যটন কেন্দ্রটির শুরুতেই বিশাল আকৃতির মানচিত্রের মাধ্যমে সুন্দরবন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। মানচিত্র পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখান থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা ছিল। এগুলো দেখে পরে সুন্দরবন ছেড়ে খুলনার উদ্দেশ্য রওনা করি আমরা।

সুন্দরবন ঘুরে যতো কিছু দেখা যায়, যা কিছু অনুভব করা যায় তার সামান্যতম অংশও লেখা যায় না। সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। আমরা এই বনের গর্বিত অভিভাবক। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়, অসংখ্য উদ্ভিদ আর প্রাণী হারায় জীবন। এরপরও এই বন আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূল জুড়ে।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.