কোটিপতি প্রার্থীদের হলফনামা যাচাইয়ের আহ্বান টিআইবির

0

ষ্টাফ রিপোর্টার/- গত দুই নির্বাচনের তুলনায় এবারের সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কোটিপতি প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন মাত্র ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। ১৫ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় ৪৭ শতাংশই কোটিপতি। অর্থাৎ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোটিপতি প্রার্থীদের পক্ষ নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘নো ইওর ক্যান্ডিডেট’ ড্যাশবোর্ড উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।

টিআইবি বলেছে, এবারের নির্বাচনে অনেক প্রার্থীরই বড় জমি (৮১৩ একর পর্যন্ত) রয়েছে। তবে দেশের আইন অনুযায়ী (ভূমি সংস্কার আইন-২০২৩) একজন ব্যক্তির জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা (কৃষি জমির ক্ষেত্রে ৬০ বিঘা এবং অকৃষি জমিসহ যা ১০০ বিঘা পর্যন্ত যেতে পারে)। এই নির্বাচনে প্রায় ২৭ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ বা দায় রয়েছে, যার মোট পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য পর্যাপ্ত নাকি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সংস্থাটি দাবি করেছে যে অন্তত একজন মন্ত্রিসভার সদস্যের বিদেশে তার নামে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যা হলফনামায় প্রতিফলিত হয়নি। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও সক্রিয়ভাবে বিদেশে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে। ওই কোম্পানিগুলোর মোট সম্পদমূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।

নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীর হলফনামায় দেওয়া আট ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে: শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ও আয়ের উৎস, মামলার বিবরণ, আয়-ব্যয়। প্রার্থীর নিজের এবং তার নির্ভরশীলদের, সম্পদ এবং দায়। টিআইবি।

প্রার্থীদের হলফনামা নিয়ে প্রশ্ন তুলে টিআইবি বলেছে, প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া আয় ও সম্পদ এবং ঋণ ও দায়-দায়িত্বের বিবরণী কতটা সঠিক ও পর্যাপ্ত এবং আইনগতভাবে আয় ও সম্পদ কতটা অর্জিত তা যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। হলফনামায় প্রার্থীরা তাদের অর্জিত সম্পদ কতটা দেখিয়েছেন, পুরোটা দেখিয়েছেন কি না বা দেশে-বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন কি না, তা যাচাই করা অনিবার্য। একইভাবে, হলফনামা বিশ্লেষণে পাওয়া আয় ও সম্পদ অর্জনের তথ্য যাচাই করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নেই, তা বৈধ আয়ের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও রাজস্ব বিভাগ তাদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করার উদ্যোগ নেবে বলে জানিয়েছে টিআইবি।

রিপোর্টের পাশাপাশি ইন্টারেক্টিভ ড্যাশবোর্ডও তৈরি করা হয়েছে। ড্যাশবোর্ড লিঙ্ক: https://www.ti-bangladesh.org/kyc বিগত চারটি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থীর সামগ্রিক, আসনভিত্তিক এবং দলভিত্তিক তুলনামূলক চিত্র দেখায়। ড্যাশবোর্ড জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মাধ্যমে ভোটাররা ঘরে বসে নিজ এলাকার প্রার্থীর তথ্য ও তুলনামূলক চিত্র পাবেন। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্যের বহুমুখী বিশ্লেষণের সুযোগ নিয়ে তাদের এখতিয়ার অনুযায়ী উদ্যোগ নিতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট শেখ মঞ্জুর-ই-আলম, কো-অর্ডিনেটর ও ড্যাশবোর্ড মেকার রিফাত রহমান এবং কে এম রফিকুল আলম। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত তিনটি এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দ্বাদশ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৩০০ আসনে কোনো দলই প্রার্থী দেয়নি। তবে শতাধিক আসনে অন্তত একটি বা অনেক ক্ষেত্রে একাধিক প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বা সমর্থক।

57 শতাংশ প্রার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ 13.66 শতাংশ প্রার্থী স্ব-শিক্ষিত। গত তিন ও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৫৭ শতাংশ ব্যবসায়ী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। গত 15 বছরে ব্যবসায়িক প্রার্থীদের অংশগ্রহণের হার 10 শতাংশ বেড়েছে।

প্রতি বছর 1 কোটি টাকা উপার্জনকারী প্রার্থীর সর্বাধিক সংখ্যা হল 164. 65.3 শতাংশ প্রার্থী যারা রুপির কম আয় করেন। এবার প্রায় ২৭ শতাংশ প্রার্থীই কোটিপতি (স্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে)। শত কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ১৮। সর্বোচ্চ কোটিপতির সম্পদ দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।

হলফনামার তুলনা করে দেখা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদের কয়েকজন সদস্যের আয় বেড়েছে দুই হাজার শতাংশের বেশি। ৫ বছরে এমপিদের সর্বোচ্চ আয় বৃদ্ধির হার ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ এবং ১৫ বছরে এ হার ৭ হাজার ১১৬ শতাংশ। একইভাবে ৫ বছরে এমপিদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫৪৭০ শতাংশ। ১৫ বছরে এই হার ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৩ শতাংশ। ৫ বছরে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীদের আয় বেড়েছে ২ হাজার ১৩৪ শতাংশ। একই সময়ে, সম্পদ 5 বছরে 1,63 শতাংশ এবং 15 বছরে 6,350 শতাংশ বেড়েছে।

হলফনামায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হফনামায় সব তথ্য সঠিক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, সম্পদের হিসাব যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে হলফনামায় সম্পদ প্রকাশ এক ধরনের দায়সারা গোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হলফনামায় মিথ্যা বা অপর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ করা আইন দ্বারা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে নজর দেওয়ার কথা তারাও এ ব্যাপারে উদাসীন ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে হলফনামায় প্রদত্ত আয়, ঋণ ও সম্পদ অর্জনের তথ্য, বিশেষ করে অনেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রীর সম্পদের অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তা না হলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্বেগজনক

এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘প্রার্থীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে হচ্ছে। আমরা দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারিনি। তবে এক শ্রেণী এতটাই সম্পদশালী হয়ে উঠেছে যে, তা ভাবতেই মর্মাহত। অন্যদিকে, বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার জীবিকা নির্বাহের অবস্থাও নেই। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যে রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করছে, সেই সময়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। কয়েকজনের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আমরা শুধু বলছি, আমরা উন্নতি করেছি। আমরা স্বল্পসংখ্যক মানুষের অত্যাচারী ভূমিকায় চলে গেছি। স্বভাবতই এই গুটিকয়েক লোক নিজেদের স্বার্থে কাজ করছে না।’

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.