বিশেষ প্রতিনিধি ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৩৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ৪৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সমিতির বিভিন্ন পদে থাকার সময় ওই অর্থ অবৈধভাবে তারা নিজের পকেটে নেন। তাদের মধ্যে একজনই আত্মসাৎ করেন প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। অন্যরা আত্মসাৎ করেন ৪ লাখ থেকে ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চিত্র। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সমিতির অর্থ লুটপাটের ঘটনাটি ঘটে।সমবায় অধিদপ্তরের ৭৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে কে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পাশাপাশি ওই অর্থ সমিতির কোষাগারে জমা দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন এরই মধ্যে মারা গেছেন এবং কয়েকজন চাকরি শেষে চলে গেছেন অবসরে। তবে অন্যরা চাকরি করে যাচ্ছেন।এদিকে, অভিযোগ ওঠার পর তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আসামিরা হলেন– রাজস্ব কর্মকর্তা ও সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মিঞা মো. মিজানুর রহমান, হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া ও কম্পিউটার অপারেটর নাইমুল হাসান।
সমিতির অর্থ লুটপাটের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের ৬ জুলাই সমবায় অধিদপ্তর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। দুই সদস্য হলেন উপসহকারী নিবন্ধক জহিরুল হক ও পরিদর্শক ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ।গত ২৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত শেষ করে সম্প্রতি কমিটি তার প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও দুদকে জমা দেয়। তদন্ত কমিটির প্রধান মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘তদন্তে যা পেয়েছি, যথাযথ প্রমাণসহ তা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি। এর কপি সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সমবায় আইনের ৮৩ ধারা অনুযায়ী আত্মসাৎ করা অর্থ আদায় ছাড়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করার নেই। এর পরও যদি অন্য কোনো সংস্থা ব্যবস্থা নিতে চায়, তাহলে নিতে পারে। কেউ চাইলে মামলাও করতে পারে। যতটুকু জানতে পেরেছি, সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে দুদক একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছে।সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সরকার বলেন, ‘দুদকের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি আমাদের কাছে একাধিকবার এসেছে। যেসব তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে, আমরা দিয়েছি। এর পর আর কিছু জানি না। তবে আমরা চাই, অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্রটা সঠিকভাবে উদ্ঘাটিত হোক। অর্থ আত্মসাৎকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।ঢাকা ওয়াসা গঠনের পর শুরু থেকে পানির মিটারের রিডিং দেখে বিল করার দায়িত্ব পালন করেন সংস্থাটির মিটার রিডাররা। ১৯৯৭ সালে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা ওয়াসার কর্মচারী সমবায় সমিতিকে। এ জন্য সমিতি প্রাইভেট পাবলিক ইন্টারেস্ট (পিপিআই) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে চুক্তি করে। শর্ত ছিল, বিল ইস্যু ও আদায়ের সব কাজ তারা করবে। বিনিময়ে ওয়াসায় জমা হওয়া অর্থের ১০ শতাংশ সমিতির তহবিলে জমা হবে। ওই অর্থ থেকে সমিতির জনবলের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হবে। উদ্বৃত্ত অর্থের সুবিধাভোগী হবেন সমিতির সাধারণ সদস্যরা। এ প্রক্রিয়ায় ভালোই লাভ করছিল ৩ হাজার ১২ সদস্যের এই সমিতি। কিন্তু পরে ওয়াসা নিজেই আবার এ কাজ করার উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ওয়াসা চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ দিয়ে বিলিং কার্যক্রম শুরু করে। ততদিনে কর্মচারী সমিতির তহবিলে মোটা অঙ্কের অর্থ জমা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমিতির তহবিল থেকে ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪৯ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা খশরু আলম খান। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনটি সঠিক নয়। কারণ সই-স্বাক্ষর করে টাকা তোলার কোনো ক্ষমতা আমার ছিল না। তাহলে আমি কীভাবে টাকা আত্মসাৎ করলাম! যারা চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান বা যাদের সই-স্বাক্ষর করার এখতিয়ার ছিল তারা এটা করতে পারেন। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুদক মামলাও করেছে।দুদকের মামলার আসামি পিপিআইর কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক মিঞা মো. মিজানুর রহমান। তদন্ত কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ ১৭ হাজার ৫৯৯ টাকা আত্মসাতের হিসাব দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, দুদকের মামলার অপর আসামি সমিতির হিসাব পরিচালনা সহকারী ও ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া আত্মসাৎ করেছেন ৪ কোটি ৭১ লাখ ৮৩ হাজার ২৩০ টাকা। আর হিসাব পরিচালনাকারী কম্পিউটার অপারেটর নাইমুল হাসান আত্মসাৎ করেছেন ১ কোটি ৪ লাখ ১ হাজার ৯৬৫ টাকা।এ প্রসঙ্গে হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘দুদক মনে হয় ব্যাংকের স্টেটমেন্ট নিয়ে তদন্ত করছে। আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি যা বলার বলেছি। ঢাকা ওয়াসা যে টাকা দিয়েছে, তার সঠিক হিসাব পিপিআই কর্তৃপক্ষকে দেয়নি। সেই রেকর্ড সঠিকভাবে পাওয়া গেলে হয়তো প্রকৃত ঘটনা বোঝা যেত। আবার অন্য ব্যবসার টাকাও সমিতির অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। পরে ব্যবসার জন্য আরেকটা অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেখানে সমিতির অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফার হয়েছে। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছি। শরীর অসুস্থ। দুদকের কারণে আমার অবসর ভাতা বন্ধ। পেনশনের টাকাও পাইনি। এখন দুদক যা করে করুক।’
কার বিরুদ্ধে কত টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার সিবিএ সভাপতি প্রয়াত হাফিজ উদ্দিন একাই আত্মসাৎ করেছেন ৪৮ কোটি ৮২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া রাজস্ব পরিদর্শক মো. জাবের হোসেন ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, সহকারী প্রকৌশলী হাসিবুর হাসান ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার, রাজস্ব কর্মকর্তা মিজানুর রহমান শাহীন ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার, সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ৯ কোটি ৫৬ লাখ ১০ হাজার, রাজস্ব পরিদর্শক ইমদাদুল হক ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার, রাজস্ব পরিদর্শক আশরাফুল আলম ১১ কোটি ৪৯ লাখ ৯৬ হাজার, রাজস্ব পরিদর্শক রোকনুজ্জামান খান ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬৬ হাজার, রাজস্ব পরিদর্শক মো. ছিদ্দিকুর রহমান ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৫৭ হাজার, পাম্পচালক ছিদ্দিকুর রহমান ৪ কোটি ৮১ লাখ ৭৮ হাজার, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান ভূঁইয়া ১১ কোটি ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার, পাম্পচালক মো. শামসুজ্জামান ১৩ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার, ওয়াসা সিবিএর সেক্রেটারি আসকার ইবনে সায়েক খাজা ৬ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার, রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার, রাজস্ব পরিদর্শক সফিকুল ইসলাম ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার এবং গাড়িচালক সংঘের সভাপতি বাবুল আলী ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
আরও যারা তালিকায়
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমিতির অর্থ লুটপাটকারীর তালিকায় আরও আছেন রাজস্ব পরিদর্শক কাজী শহীদ উল্লাহ, রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. বদিউল আলম, হিসাব সহকারী বেগম লুৎফুন্নাহার, কামাল হোসেন, এস এ আনোয়ার সাত্তার সবুজ, জাহিদুল ইসলাম, এস এম জাহাঙ্গীর, আবু বকর সিদ্দিক, পাম্পচালক আবুল কালাম মোল্লাহ, রাজস্ব পরিদর্শক রোকনুজ্জামান খান, রিয়াজ উদ্দিন, হিসাব সহকারী দুলাল চন্দ্র সাহা, পাম্পচালক ফজলুল হক, রাজস্ব পরিদর্শক আতাউর রহমান মিয়া, আজিজুল ইসলাম, মির্জা আবদুর রহিম, এস এম ফরিদ উদ্দিন, আজিজুল আলম খান, আনিছুর রহমান, আবদুল মান্নান, আজফার উজ্জামান সোহরাব, মো. আখতারুজ্জামান, সাবেক সিবিএ সভাপতি মো. হাফিজ উদ্দিন, রাজস্ব পরিদর্শক মো. জামাল উদ্দিন, মাজহারুল হান্নান ও সন্তোষ মালাকার। তারা বিভিন্ন সময় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ওই সময়ই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সব মিলিয়ে আত্মসাৎ হয়েছে ৩৩২ কোটি ৫২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।