বিশেষ প্রতিবেদকঃ আন্তর্জাতিক গেটওয়ের লাইসেন্সগুলো ২০১২ সালেই রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে দিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ওই সময় ইন্টারনেট ও টেলিফোনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য গেটওয়ে লাইসেন্স দরপত্র জমা পড়ে ১৫৩টি। এর মধ্যে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) ৪৩, আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) ৫৯ এবং আইসিএক্স (ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন এক্সচেঞ্জ) ৫১টি। সে সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা বলছেন, এসব লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসার আড়ালে হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আর নামে-বেনামে এসব লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে শামীম ওসমান, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অনেকের নাম পাওয়া গেছে।বিটিআরসিসূত্র জানিয়েছেন, ওই সময় প্রভাব খাটিয়ে বৈদেশিক কল আদানপ্রদানে মোট ৮৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে তিন ধরনের গেটওয়ে লাইসেন্সের সুপারিশ করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। মূলত রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ সময় লাইসেন্স পাননি। এরপর যারা পেয়েছেন তারা অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স বিক্রিও করে দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সে সময় গেটওয়ে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নামে-বেনামে যুক্ত থাকেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেটওয়ে লাইসেন্স পেয়ে তা বিক্রির জন্য ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি বিজ্ঞাপন দেন মেহেদী হাসান নামে এক ব্যক্তি। ওই বিজ্ঞাপনে তিনি জানান, বিটিআরসি অনুমোদিত বহুল আকাক্সিক্ষত আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স ও আইআইজি লাইসেন্স এখন আপনার হাতের নাগালে। বিক্রয়যোগ্য কোম্পানির সংখ্যা আইজিডব্লিউপ্রাপ্ত ৮, আইসিএক্সপ্রাপ্ত ৬ ও আইআইজিপ্রাপ্ত ১৬টি। দুদকসূত্র জানান, সরকারের শত কোটির বেশি টাকা পাওনা না মিটিয়ে ২০১৪ সালে লাপাত্তা হয়ে যায় একটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) অপারেটর প্রতিষ্ঠান। ‘কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠানটি যেখানে ছিল সেখানে এখন আর তার অস্তিত্ব নেই। বিটিআরসি হদিস না পেয়ে ওই বছরের ২০ মে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিখোঁজ হওয়ার তথ্য প্রকাশ করে। এরপর ২২ জুন রাজধানীর বনানী থানায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা হয়। কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেড সাবেক এমপি শামীম ওসমান পরিবারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আইজিডব্লিউ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার পর প্রায় তিন বছর বিটিআরসির খাতায় এর মালিক হিসেবে শামীম ওসমানের স্ত্রী সেলিমা ওসমান (চেয়ারম্যান), ছেলে ইমতিয়ান ওসমান, শ্যালক তানভির আহমেদ (ব্যবস্থাপনা পরিচালক), শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিথ কনসার্নের মালিক জয়নাল আবেদীন মোল্লা ও জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লার নাম ছিল। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট এ নামগুলো বদলে মো. শাখাওয়াত হোসেন, দেবব্রত চৌধুরী ও রাকিবুল ইসলাম লেখা হয়। কিন্তু এ ব্যক্তিদের অস্তিত্ব আর পাওয়া যায়নি। তাদের যে ঠিকানা দেওয়া হয় তা-ও ভুয়া। ফলে মালিকানা বদলের ঘটনাটি রহস্য বলেই অনেকের ধারণা। প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকার তথা বিটিআরসির পাওনা ১০৩ কোটি ১০ লাখ ৩৩২.৬৪ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক কল আদানপ্রদান থেকে রাজস্ব বাবদ ৮৮ কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৬২৬.৬৪, বার্ষিক লাইসেন্স ফির ওপর ভ্যাট ১ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার ও বিলম্ব ফি ৬ কোটি ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৬৯৬ টাকা রয়েছে। এদিকে চলতি বছরের ২৬ মে প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে আন্তর্জাতিক টেলিফোন কলের (আইজিডব্লিউ) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বেসটেক টেলিকম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) উপপরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।সংস্থাটির খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জালাল উদ্দিন আহাম্মদ সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১-এ মামলা করেন। বেসটেক টেলিকম লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. তরিকুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েত কবির এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব শাখার উপপরিচালক হাসিবুল কবিরকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অভিযোগ আনা হয়। আন্তর্জাতিক গেটওয়ের লাইসেন্স নিয়ে অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক গেটওয়ের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান শেষ হয়েছে, আগামীতে এসব ঘটনায় কয়েকটি মামলা হওয়ার কথা রয়েছে।
- Advertisement -