LastNews24
Online News Paper In Bangladesh

সিনেমা জগতের নোংরা পলিটিকস আমার ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিয়েছে: আমিন খান

বিনোদন ডেস্ক  ‘বলিউডে এখন সুশান্ত সিং রাজপুতকে নিয়ে সবাই যে হাহুতাশ করছে, আমার জীবনটাও তেমন হতে পারত। চলচ্চিত্রজগতে আমিও অনেক নোংরা পলিটিকসের শিকার হয়েছি। মনোবল শক্ত ছিল, পরিবার পাশে ছিল, তাই হয়তো আত্মহত্যা করিনি। আমার মতো করে লড়ে গেছি। চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিয়েছি।’ কথাগুলো বাংলাদেশের একসময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক আমিন খানের। একসময় শুটিংয়ে অ্যাকশন, কাট শুনে অভ্যস্ত চিত্রনায়ক আমিন খান এখন ব্যস্ত চাকরিজীবনে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় দায়িত্বে আছেন। কয়েক মাস আগে নতুন করে আলোচনায় আসেন    আরাভ খান কাণ্ডে। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খানকে নিয়ে বেশ কিছু খবর। নামের মিল থাকায় অনেকে মনে করছেন, ওই আরাভ খান বাংলাদেশের চিত্রনায়ক আমিন খানের ভাই, যা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে আমিন খানের পরিবারকে। প্রথম আলোকে আমিন খান বলেন, ‘দুবাইয়ের আরাভ খান আমার ভাই নন। কী যে এক ঝামেলায় পড়েছি! আরাভ খান নামের আমার কোনো ভাই নেই। যে আরাভ খান মনে করে অনেকেই আমার কাছে জানতে চাচ্ছেন তিনি কি আমার ভাই, সেই আরাভ খানকে আমি চিনি না। গণমাধ্যমের খবরে জানতে পারলাম তাঁর কথা। অনেকেই ভুল করে তাঁকে আমার ভাই মনে করছেন, জানতে চাইছেন—এই ঘটনায় বিব্রত বোধ করছি। আমার ভাইয়ের নাম আশরাফুল ইসলাম। সে একটি সিনেমায় অভিনয় করেছিল। সেখানে তার নাম আরাভ থাকতে পারে। এখান থেকে কেউ কেউ মনে করছেন তিনিই আমার ভাই। এ ঘটনায় সবার ভুলটা ভাঙানো দরকার।’ আমিন খান এখন সে রকমভাবে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে নেই। স্ত্রী স্নিগ্ধা খান, দুই ছেলে রাইয়ান খান আর মাঈন খানকে নিয়ে বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় থাকেন। দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। আমিন খান বললেন, ‘চলচ্চিত্রের জীবনটা খুব মিস করি। ওটাই আমাকে নতুন জন্ম দিয়েছে। নায়ক আমিন খান হয়ে বাঁচতে চাই।’ গত শতকের নব্বই দশকে নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর শুরু। এই কার্যক্রমে নির্বাচিত হয়েও ফিল্মি পলিটিকসের কারণে দুই বছর কোনো ছবির কাজ করতে পারেননি। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায় প্রথম সিনেমা ‘অবুঝ দুটি মন’। মোহাম্মদ হোসেন পরিচালিত এই ছবি মুক্তির আগে বাদল খন্দকারের ‘দুনিয়ার বাদশা’ ছবিতে কাজ করেন। ছবিটি সুপারহিট ব্যবসা করে। এই ছবিই তাঁকে অ্যাকশন ঘরানার আগ্রহী হওয়ার রাস্তা তৈরি করে দেয়, তার আগে মুখোমুখি হতে হয় অনেক ঘটনার।চাচার উৎসাহে ১৯৯০ সালে এফডিসি আয়োজিত নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে অংশ নেন আমিন খান। সে সময় ২০ থেকে ২২ হাজার প্রতিযোগীর মধ্য থেকে নিজেকে সেরা হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরেন। সে সময়কার কথা মনে করে আমিন খান বললেন, ‘খুলনা থেকে ঢাকায় আসি। মফস্‌সল শহর থেকে আসা আমি কাউকে চিনি না, জানি না। একমাত্র অভিভাবক আমার চাচা। তিনিও সিনেমার কেউ নন। ডানে যাব না, বাঁয়ে যাব, কিছুই জানি না। তারপরও অডিশনে টিকে গেলাম। অডিশনের পরই বাংলাদেশের স্বনামধন্য ও প্রভাবশালী একজন পরিচালক আমাকে দিয়ে ছবি বানানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। প্রতিযোগিতা শেষে ছবির নামও ঘোষণা করলেন, কিন্তু আমাকে নিলেন না। আমি চুপচাপ রইলাম। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে চলেছি। তা না হলে হয়তো আত্মহত্যা করতাম। এর মধ্যে সে সময় সবচেয়ে মেগা হিট তিনটা ছবির প্রস্তাবও আমার কাছে আসে। কিন্তু পরিচালককে কথা দেওয়ার কারণে ছবিগুলো আমার করা হয়নি। ওই পরিচালকের একজন শিষ্য আমাকে নিয়ে ছবি বানাতে চাইলেন, অজ্ঞাত কারণে তা–ও হলো না! “অবুঝ দুটি মন” করার আগে তিনটা ছবির সাইনিং মানি নিয়েছিলাম। কোনোটিতে কাজ করা হচ্ছে না। এদিকে আমাকে প্রস্তাব দেওয়া ছবিগুলোও মুক্তি পেতে লাগল, মন খারাপ লাগা শুরু হলো। বুঝে গেছি, পলিটিকসে পড়ে গেছি। চাচার সঙ্গে ইস্কাটনে থাকতাম। লজ্জায় বাড়িতেও যেতে পারতাম না। দুই বছরে ঈদেও খুলনায় যেতে পারিনি।’ তবে এই কষ্টের সময়ে সে সময়ের সাংবাদিকদের খুব ভালোভাবে পাশে পেয়েছেন আমিন খান। তাঁরা এই আমিন খান নামটিও দেন। সবার কাছে আমিন খান নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম ছিল আমিনুল ইসলাম খান, ডাকনাম আমিন। ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিতি অনুষ্ঠানে নামটি দেন তাঁরা। আমিন খান বললেন, ‘সে সময়ের সাংবাদিকেরা আমাকে মানসিকভাবে ভীষণ সাপোর্ট করেছেন। ভাই, বন্ধুর মতো ছিলেন। সাংবাদিক আহমেদ কামরুল মিজান ভাই তো “অবুঝ দুটি মন” ছবিতে অভিনয়ের ব্যবস্থা করে দেন। এই পরিচালকের “আজকের হাঙ্গামা” ছবিটি তখন সুপারহিট, ওই ছবির প্রস্তাবও আমার কাছে এসেছিল। তত দিনে নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম থেকে নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর কেটে গেছে। ভাবলাম, এখন আর বসে থাকার মানে হয় না। তারপর কাজ শুরু করলাম। কার্টেসি হিসেবে সেই প্রভাবশালী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। জানতে পারি, তিনি দেশের বাইরে। তাঁর ঢাকায় আসার আগে আমার ছবির মহরত আর শুটিং শুরু হয়ে যায়। আসার খবর শুনেই তাঁকে আবার বলতে যাই, তখন যে খারাপ ব্যবহার আমার সঙ্গে করেছিলেন, আশাহত হলাম। চরম বাজে ব্যবহার, যা আজও ভাবলে অবাক হই। এফডিসিতে পা ধরে সালাম করতে চাইলে পা সরিয়ে নেন। তাঁদের বড় একটা সিন্ডিকেট ছিল। আমার প্রথম ছবি রিলিজের পর এই সিন্ডিকেট সক্রিয় হলো। নেতিবাচক প্রচারণা করতে লাগল। ১০ বছর আমাকে তাঁদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাজ করতে দেয়নি।’ খুলনা থেকে ঢাকায় আসার পর নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে নির্বাচিত হওয়ার পর সিনেমাকে পেশা ভাবতে শুরু করেন। আমিন খানের মতে, তাঁর পেছন ফিরে যাওয়ার জায়গাও ছিল না। তাই শত বঞ্চনা সত্ত্বেও মাটি কামডে পড়ে ছিলেন। সমস্যা যেন পিছু ছাড়ে না আমিনের। ‘অবুঝ দুটি মন’ মুক্তির দুই বছর পর কাজ শুরু করেন ‘প্রিয়জন’ ছবির। এর মধ্যে আরও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে তাঁর। ত্রিভুজ প্রেমের সেই গল্পের ছবির পরিচালক মোহাম্মদ হোসেনই। এরপর কী ঘটল, তা শুনুন আমিন খানের বয়ানে, ‘১৯৯৫ সালে ব্যাংককে “প্রিয়জন” ছবির শুটিং করতে গেলাম। আমি ছাড়াও আছেন রিয়াজ, শিল্পী। ১২ দিনের শুটিংও করলাম। গান, দৃশ্য, অনেক কিছুই করা হয়েছে। ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকায় আসার পর আমার সঙ্গে ছবিসংশ্লিষ্ট কারও যোগাযোগ নেই। এরই মধ্যে সাংবাদিকেরা আমাকে জানালেন, সালমান শাহকে নিয়ে “প্রিয়জন” ছবির মহরত হবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। কী পরিমাণ হতাশায় পড়ে যাই বলে বোঝাতে পারব না। আমি সিনেমার জন্মদাতা মোহাম্মদ হোসেনের কাছে জানতে চাই তাঁর ছবি থেকে এভাবে বাদ পড়ার অর্থ। তিনি বলেন—আমিন খান তুমি ভালো অভিনেতা না, বাজারে তোমার চাহিদা নেই, তাই তোমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। রাগে-দুঃখে–কষ্টে এফডিসিতে যাওয়া বন্ধ করে দিই। এর মধ্যে একদিন আমারই আরেকটা ছবির ডাবিং করে বের হয়ে দেখছি, সেই “প্রিয়জন” ছবিরই শুটিং হচ্ছে ডাবিং থিয়েটারের সামনে। বলতে পারেন, আমার জীবন সিনেমার মতো হয়ে গেল! আবার বড় একটা আঘাত। সৃষ্টিকর্তার কী নির্মম পরিহাস, সালমান শাহ তখন হটকেক। তার আগপর্যন্ত কোনো ফ্লপ নেই তার ডিকশনারিতে। “প্রিয়জন” দিয়েই প্রথম ফ্লপের দেখা পায়। ভাগ্য ভালো আমি ছিলাম না, তা না হলে ফ্লপের ভাগিদার আমিই হতাম। আমি তখন সময় কাটাতে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। তখন কাজের চাপও ছিল না। একটা সময় ওই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছি।’১৯৯৩ সাল থেকে একটানা ২০০২ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন আমিন খান। ১৯৯৮ সালে বিয়ে করেন। ২০০২ সালে প্রথম বাবা হন। জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগার পর দুই বছরের মাথায় তাঁর সেই সন্তান মারা যায়। এই দুই বছরে মাত্র তিনটি ছবিতে কাজ করেন তিনি। এরপর তাঁকে আবার কাজে নামতে হয়। টানা ২০১০ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৬৫টির মতো ছবিতে কাজ করেন। এরপর আগ্রহ কমতে থাকে। আমিন খান বলেন,‌ ‘২০০৮ সালে মান্না ভাই মারা যাওয়ার পর আরেকটা গ্রুপ সক্রিয় হলো। সিন্ডিকেট তৈরি হলো। আমাদের সময়ে যারা প্রোডাকশন বয় কিংবা ক্রেন চালাত, তারা প্রযোজক বনে গেল! তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক কিছু করা শুরু করল। ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভাবল না। আমার কাছে বিষয়গুলো পছন্দ না হওয়াতে সরে গেলাম। আর নিয়মিত হলাম না।’ দেশের সিনেমায় লম্বা সময় ধরে কাজ করতে গিয়ে একটা উপলব্ধি হয়েছে আমিন খানের। জানালেন, সারা পৃথিবীতে ছবিতে কাস্টিং ডিরেক্টর থাকেন। গল্পের প্রয়োজনে যাঁকে কাস্টিং করা দরকার, তিনি তাঁকে নির্বাচিত করেন। অডিশন নেন। অথচ বাংলাদেশে এই মনোভাব তৈরি হয়নি। নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথাও বললেন একসময়ের জনপ্রিয় এই নায়ক। ‘একবার প্রযোজক ও পরিচালক আমার কাছে অসাধারণ একটা গল্প নিয়ে হাজির হলেন। সবকিছু শোনার পর তাঁদের বলেছিলাম, আমাকে নিয়েন না, এই ছবিতে রিয়াজকে নিয়েন, ভালো হবে। কারণ, আমার রোমান্টিসিজমের প্যাটার্ন আলাদা, অন্য রকম। পরিচালক ও প্রযোজক আমার কথা শুনে থ হয়ে যান।’ বললেন আমিন খান। বাংলাদেশের ছবির কাজে এখনো পেশাদারি মনোভাব গড়ে ওঠেনি বলে মত দিয়েছেন আমিন খান। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশে প্রফেশনালিজমের চেয়ে ইমোশনাল ব্যাপারগুলো কাজ করে বেশি। যাঁর সঙ্গে যাঁর খাতির বেশি, আবদারের সম্পর্ক, তাঁকে দিয়ে কাজ করানো হয় বেশি; যা অনেক বড় একটা অন্তরায়। বলতে পারেন চলচ্চিত্রজগতের পলিটিকস আমার ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’

About Author

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More