পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, অবৈধ অস্ত্রে খুনাখুনির অভিযোগ পেয়ে তদন্ত চলছে। সেই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করেছে। যৌথ অভিযানে গত ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৩১৮টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এই সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৭৪ জন সন্ত্রাসীকে। উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রিভলভার ১৯টি, পিস্তল ৭৬টি, রাইফেল ২২টি, শটগান ৩৭টি, পাইপগান আটটি, শ্যুটার গান ৪৩টি, এলজি ৩১টি, বন্দুক ৪৮টি, একে৪৭ একটি, এসএমজি পাঁচটি, গ্যাসগান চারটি, এয়ারগান ১০টি, এসবিবিএল ১০টি, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার দুটি এবং থ্রি-কোয়ার্টার দুটি।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, এখনো অনেক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে থানা থেকে লুট হওয়া বেশির ভাগ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। সেসব অস্ত্রও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গত আড়াই মাসেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। সারা দেশেই প্রতিদিন হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। এতে মানুষ স্বস্তিতে নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশেই অপরাধ বাড়ছে। গত দুই মাসে সারা দেশে ৬২৫ জন নিহত হওয়ার তথ্য মিলেছে। তবে রাজধানী ও চট্টগ্রামের অপরাধচিত্র বেশি খারাপ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় হত্যা, ছিনতাই, দখল, চাঁদাবাজিসহ তুচ্ছ কারণে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম সাংবাদিককে বলেন, ‘দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে অনেক অবৈধ অস্ত্র।’
এক এলাকায়ই পর পর ৭ খুন
গত বুধবার মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে কাল্লু ওরফে জানে নেওয়াজ হত্যার পর সরেজমিনে ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় সন্ত্রাসী ভুঁইয়া সোহেল, টুনটন, রানা, কাউসারসহ একদল সন্ত্রাসী নেওয়াজ হত্যায় জড়িত। সবাই ক্যাম্পের মাদক কারবারি। দীর্ঘদিন ধরে বিহারি ক্যাম্পে তারা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। প্রকাশ্যে এরা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের মতো আরো অন্তত সাতটি গ্রুপ ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। সবাই মাদক কারবারি।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, কাল্লু হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে বুধবার দিবাগত শেষরাতে মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় শাহরিয়ার আশিক নামে ২০ বছরের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল লোক। পরদিন বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ক্যাম্পের অদূরে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ কাঁচাবাজার মার্কেটের অফিসকক্ষে ঢুকে মার্কেটটির সভাপতি আবুল হোসেন ও তাঁর ছোট ভাই মাহবুবকে প্রকাশ্যে গুলি করে সন্ত্রাসীরা।
তাঁরা এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এর দুই দিন পর রবিবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড এলাকায় ব্যস্ত সড়কে দিনদুপুরে অস্ত্রধারী ডাকাতদল বেসরকারি নেসলে কম্পানির কর্মকর্তাকে মারধর করে গাড়ি আটকে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।
এখানেই শেষ নয়, এর আগে গত ৫ আগস্ট রাত থেকে জেনেভা ক্যাম্পে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ চলে ৯ আগস্ট পর্যন্ত। এর মধ্যে ৬ আগস্ট ক্যাম্পে গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামের এক যুবক। একই দিনে গলায় গুলিবিদ্ধ হন শুভ নামের আরেক যুবক। পরে ১৭ আগস্ট আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়, যা চলে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত। আরেক দফা বিরতির পর আবার ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সোহেলের গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। আহত হন কুরাইশ।
এরপর ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি ও গোলাগুলি। এর মধ্যে চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম এবং ২৩ সেপ্টেম্বর চারকো ইরফান গুলিবিদ্ধ হন। আর ২৪ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ সাগর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৫টার দিকে মারা যান। তিনি পেশায় কসাই ছিলেন। এর আগে ৩১ মে ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলিতে মারা যায় রাসেল নামের এক শিশু। সে ও সাগর ছাড়া নিহত অন্য দুজন সেলিমের পক্ষের লোক ছিলেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, বেপরোয়া অপরাধীদের কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই। রাজধানীসহ দেশে প্রতিদিনই খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডাকাতি, ছিনতাইয়ের পাশাপাশি চাঁদার দাবিতে ব্যবসায়ীকে গুলি করার অভিযোগও মিলছে। সেই সঙ্গে সামাজিক বিরোধে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, শীর্ষ মাদক কারবারি ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, মোল্লা জাহিদ, বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু ও তার ভাই আলতাফ বাম, দিল্লি সাঈদ ও তার ভাগনে ইরফান মোল্লা আরশাদ, পেলু আরমান, কোপ মনু, আকরাম, গেইল হীরাসহ শতাধিক মাদক কারবারি সন্ত্রাসী রয়েছে এই ক্যাম্পে।
ক্যাম্পে বর্তমানে ভূঁইয়া সোহেল চক্রের কাছে তিনটি বিদেশি অস্ত্রসহ আটটি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। মিরপুরের কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে জনৈক আরমানের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো কেনা হয়। সোহেলের সহযোগীদের কাছে রয়েছে থানা থেকে লুট করা দুটি বন্দুক। এ ছাড়া সোহেলের সহযোগী হিসেবে কাজ করা সৈয়দপুরিয়া বাবুর কাছে থানা থেকে লুট করা পুলিশের দুটিসহ তিনটি অস্ত্র আছে।
বাবু ছাড়াও তার সহযোগী সাজ্জাদ, ইরফান ও দিল্লি শাহিদের কাছে অস্ত্র রয়েছে। এর বাইরে সোহেলের প্রতিপক্ষ চুয়া সেলিম গ্রুপের কাছে থানা থেকে লুট করা দুটিসহ চারটি অস্ত্র এবং তার সহযোগী উল্টা সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম ও শাহজাদার কাছে রয়েছে একাধিক অস্ত্র।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবির খান বলেন, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অস্ত্র উদ্ধারে মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অনেক অভিযানে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে সমাজে হানাহানি আরো বাড়বে। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গুলিতে অনেক মানুষ মারা গেছে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। দ্রুত এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’