LastNews24
Online News Paper In Bangladesh

প্রতিটি পরিবার গত বছর গড়ে ঘুষ দিয়েছে ৬৬৩৬ টাকা

0

বিশেষ প্রতিনিধি সেবা পেতে দেশের ৭০.৯ শতাংশ খানা বা পরিবারকে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। আর ৪০.১ শতাংশ পরিবারকে সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে। দেশের সেবা খাতের দুর্নীতি ও ঘুষের সার্বিক চিত্র দেখতে জরিপ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাতে এই চিত্র উঠে এসেছে।জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে।জরিপের সময়কাল ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর। দৈবচয়নের মাধ্যমে ১৩২০ খানার ওপর এই জরিপ করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা ১৭টি সেবার কোন খাতে কে কী পরিমাণ দিয়েছেন তা বর্ণনা করেছেন। এতে দেখা যায়, ওই সময়কালে ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে।গতকাল বুধবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের তথ্য জানায় টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ফারহানা রহমান ও নূরে আলম মিলটন। দেশের আটটি বিভাগকে ১৬টি স্তরের ভাগ করে জনসংখ্যার অনুপাতে শহর-গ্রাম মিলিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, শহরের মানুষের (৩৬.৬%) তুলনায় গ্রামের মানুষকে (৪৬.৫%) বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে। ৭২.১ শতাংশ খানাবাসী বলেছেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না।টিআইবি বলেছে, প্রতিটি পরিবারকে সেবা নিতে গিয়ে গড়ে ছয় হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। জনপ্রতি ঘুষ দেওয়ার পরিমাণ ৬৭১ টাকা।

জরিপের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষের হার কমেছে; কিন্তু ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে। ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কোনো কোনো সেবা খাতে তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দুর্নীতি একই অবস্থায় রয়েছে (যেমন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ ইত্যাদি)। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বীমা ইত্যাদি কিছু খাতে দুর্নীতি বেড়েছে।টিআইবির সেবা খাতে দুর্নীতি-২০২১ জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাতটি হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা। এই সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭৪.৪ শতাংশ পরিবার। আর ঘুষ দিতে হয়েছে ৫৫.৭ শতাংশ পরিবারকে। টাকার অঙ্কে তা গড়ে ছয় হাজার ৬৯৮। এই খাতে সেবা নিতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে ৫৮ শতাংশ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। শহরাঞ্চলে তা ৫৪.৬ শতাংশ। শহরে খানাপ্রতি ঘুষ দিতে হয়েছে সাত হাজার ১৭০ টাকা। গ্রামে পাঁচ হাজার ১৭৬ টাকা। ১১.৯ শতাংশ খানার মানুষ অসদাচরণের শিকার হয়েছেন। মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি পেয়েছেন ৫ শতাংশ।সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই সেবা খাতে দুর্নীতি হয়। পার্থক্য হচ্ছে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর প্রয়োগ আমাদের দেশে দেখা যায় না। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা থাকলেও তা বাস্তবায়নের দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা সেটি করছেন না। ’ তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের প্রক্রিয়া পর্যাপ্ত নয়। যেটুকু আছে তার ওপরও মানুষের আস্থার অভাব।

পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী, শৃঙ্খলা মেনেই চলতে হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে শৃঙ্খলা শাখা প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। মো. কামরুজ্জামান বলেন, কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগে দুর্নীতি নির্মূল করতে নিয়ম পাল্টানো হয়েছে। পদায়ন ও পদোন্নতি এখন কেন্দ্রীয়ভাবে হচ্ছে। দুর্নীতি সমূলে উৎপাটনের এগুলো দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে টিআইবি কোথা থেকে কিভাবে এই সমীক্ষা করেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই সমীক্ষার ব্যাপারে আমরা জানি না। ’

দ্বিতীয় স্থানে পাসপোর্ট অধিদপ্তর

টিআইবির জরিপ অনুযায়ী, দুর্নীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এই বিভাগে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭০.৫ শতাংশ খানার মানুষ। আর ঘুষ দিতে হয়েছে ৫৫.৮ শতাংশকে। গড়ে প্রতিটি খানাকে দিতে হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫ টাকা করে। গ্রামাঞ্চলের ঘুষের পরিমাণ বেশি, খানাপ্রতি গড়ে পাঁচ হাজার ২২৯ টাকা। শহরে চার হাজার ৯১৫ টাকা।টিআইবির জরিপের ফলাফল জানিয়ে বক্তব্য চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী গতকাল বুধবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি রিপোর্টটি এখনো দেখিনি। কিসের ভিত্তিতে তারা করল, সেটা দেখে বলতে হবে। ’

তৃতীয় বিআরটিএ

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে সেবা নিতে গিয়ে ৬৮.৩ শতাংশ খানার মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আর সরাসরি ঘুষ দিতে হয়েছে ৫০.২ শতাংশকে। এখানেও গ্রামের মানুষ বেশি (৭৬.৮ শতাংশ) দুর্নীতির শিকার হয়েছে। শহরে এই হার ৬৬.৬ শতাংশ। ঘুষও গ্রামের মানুষকে বেশি দিতে হয়েছে (৭৫.৩ শতাংশ)। শহরের ৫৪.৬ শতাংশ খানা ঘুষ দিয়ে সেবা নিয়েছে। গড়ে প্রতিটি খানাকে দিতে হয়েছে পাঁচ হাজার ১৪৭ টাকা।জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, টিআইবির প্রতিবেদনের তথ্যসূত্র পরিষ্কার নয়। এমন মনগড়া ঢালাও প্রতিবেদনের কোনো যুক্তি নেই। তিনি বলেন, ‘যদি কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ব্যবস্থা নেব। ’

বিচারিক সেবা

বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে ৫৬.৮ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের (৫২.৬ শতাংশ) চেয়ে শহরের বেশিসংখ্যক খানা (৫৯.৯ শতাংশ) দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আর ঘুষ দিতে হয়েছে ২৩.৭ শতাংশ খানাকে। গড়ে প্রতিটি খানা দিয়েছে ১৯ হাজার ৯৬ টাকা করে। এই সেবা নিতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঘুষ দিতে হয়েছে ২২.৭ শতাংশ খানাকে আর শহরে ঘুষ দিতে হয়েছে ২৪.৪ খানাকে।

স্বাস্থ্যসেবা খাত

সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে ৪৮.৭ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গ্রামে ৪৪.৮ শতাংশ এবং শহরে ৫০.৯৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়। এই সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে ৬.২ শতাংশ খানাকে। গড়ে প্রতিটি খানাকে দিতে হয়েছে ৬৮০ টাকা।জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘এই বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। এর সত্যতা যাচাই করতে হবে। ’

স্থানীয় সরকার

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে ৪৬.৬ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ৪৮.২ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে দুর্নীতির শিকার ৪৫.৪ শতাংশ খানা। ঘুষ দিতে হয়েছে ৩৩.৫ শতাংশ খানাকে। প্রতিটি খানার গড় ঘুষের পরিমাণ এক হাজার ১১২ টাকা। গ্রামের মানুষকে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে।জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মলয় চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুর্নীতির ন্যূনতম অভিযোগ এলেও কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হয় না। অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে আইনে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আছে, সেটি নেওয়া হয়। ’ তিনি আরো বলেন, ‘টিআইবি কিসের ভিত্তিতে এমন প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটি আমাদের জানা নেই। বাস্তবতার সঙ্গে এই প্রতিবেদনের কোনো মিল আছে বলে মনে হয় না। ’

ভূমি

ভূমি খাতে সেবা নিতে এসে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৪৬.৩ শতাংশ খানা, এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ৪২.৮ শতাংশ আর শহরাঞ্চলে ৪৮.৮ শতাংশ। ঘুষ দিয়েছে এমন খানার সংখ্যা ৩১.৫ শতাংশ। গড় ঘুষের পরিমাণ সাত হাজার ২৭১ টাকা।টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ খাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা, কৃষি, বীমা, এনজিও, জ্বালানি, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক বিভাগ থেকে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে মানুষ।ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে, তার কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সারা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

সুপারিশ

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে টিআইবি ১০টি সুপারিশও করেছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নেওয়া, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সক্রিয় ভূমিকা পালন করা, সব সেবা ডিজিটাইজ করা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা, সেবা প্রদানকারীদের আচরণগত বিষয়গুলো জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন ও কার্যকর করা, সেবাদানের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করা, গণশুনানির মতো অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করা, নাগরিক সনদে সেবামূল্য সম্পর্কিত তথ্য হালনাগাদ করে দৃষ্টিসীমায় রাখা, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়া (জিআরএস) সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং সব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

About Author

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More