পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও বাসে আগুনে জড়িতরা শনাক্ত: ডিবিপ্রধান

0

বিশেষ প্রতিনিধি বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষ, হরতাল ও অবরোধে নাশকতায় অভিযুক্তদের ধরতে দেশব্যাপী চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে জেলা, থানা, মহানগরসহ বিভিন্ন ইউনিটের বহু নেতাকর্মী। অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে রয়েছেন আত্মগোপনে। গত বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, ফুটেজ দেখেও নাশকতায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে।গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনকে আদালতের মাধ্যমে ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের সময় কুপিয়ে ও পিটিয়ে পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলামকে হত্যার মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয় তাদের। এদিকে গতকাল রিমান্ড শুনানির সময় আমীর খসরু অভিযোগ করেন, সরকার আগামী নির্বাচনে আবারও ভোট চুরি করে ক্ষমতায় থাকতে গায়েবি মামলা দিচ্ছে।একই দিন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশালের সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল ভোরে তাঁকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ হত্যা মামলায় গতকাল সুনামগঞ্জ জেলা যুবদলের সভাপতি আনসার উদ্দিনকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। এ ছাড়া বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য ইশরাক হোসেনের ছোট ভাই ইশফাক হোসেনসহ ছয়জনকে রিমান্ড শেষে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে সহিংসতার ঘটনায় বুধবার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৬৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলা। এসব মামলায় আসামির তালিকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ শীর্ষ নেতারা রয়েছেন। ২৯ অক্টোবর প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় মির্জা ফখরুলকে। ৩১ অক্টোবর মির্জা আব্বাস ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হন আমীর খসরু ও জহির উদ্দিন স্বপন। গতকাল ভোরে গ্রেপ্তার হন মজিবর রহমান সরোয়ার। ২৮ অক্টোবর থেকে গত বুধবার পর্যন্ত মোট গ্রেপ্তার সংখ্যা ১ হাজার ৩৪৭। গতকাল সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ঢাকায় মোট গ্রেপ্তার সংখ্যা গণমাধ্যমকে জানায়নি ডিএমপির মিডিয়া শাখা। তবে আদালত সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকায় বিএনপির ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে হামলা, যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্য খুন ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলায় জড়িতদের নাম পাওয়া গেছে। শিগগির তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর কাদের নেতৃত্বে ও ইন্ধনে হামলা হয়েছিল খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হবে তাদেরও। গতকাল মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।আমীর খসরুকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘তাঁকে আমরা অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম। তিনি গুলশানের একটি বাসায় পালিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি পুলিশ সদস্য আমিরুল হত্যা মামলার চার নম্বর আসামি।’

পুলিশ হত্যা মামলায় আমীর খসরু ও জহির উদ্দিন স্বপনকে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে গতকাল ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। অন্যদিকে, তাদের জামিন চেয়ে শুনানি করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। শুনানিকালে আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন আমীর খসরু। তিনি আদালতকে বলেন, ‘এ মামলার মতো বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা রয়েছে। বাংলাদেশে এত মিথ্যা মামলা একসঙ্গে আগে দেখা যায়নি। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন দল নয় যে, তাদের সন্ত্রাস করতে হবে। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে হামলা-মামলা করা হচ্ছে। আমরা কেন সহিংসতা করতে যাব? আমরা মহাসমাবেশ ডাকলে লাখ লাখ লোক জড়ো হয়। দুঃখের বিষয়, সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে জনগণ। তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এসব মামলা দেওয়া হয়েছে।’ শুনানি শেষে আমীর খসরু ও স্বপনের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এদিকে পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভাঙচুরের অভিযোগে পল্টন থানার মামলায় মজিবর রহমান সরোয়ারকে গতকাল দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়। অবশ্য তাঁর রিমান্ড চাওয়া হয়নি। এ সময় তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

বিভিন্ন জেলায় গ্রেপ্তার শতাধিক

তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিতে সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় আরও শতাধিক মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে ঢাকায় ২৮ অক্টোবর পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার আসামি সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি সহসভাপতি আনছার উদ্দিনকে গতকাল সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে তিন পুলিশকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় পাঁচ বিএনপি কর্মীকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে একই দিন ককটেল বিস্ফোরণে সাত পুলিশ সদস্য আহতের ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান সুখনসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন।

কিশোরগঞ্জে পৌর বিএনপির সভাপতি আমিনুল ইসলাম আশফাককে না পেয়ে তাঁর যমজ ছেলে শহীদুল ইসলাম অনিক ও মাকসুদুল ইসলাম আবিরকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর থানার ওসি মোহাম্মদ দাউদ দাবি করেছেন, হরতাল ও অবরোধের সময় হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমিনুল আশফাকের দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এ ছাড়া নাশকতার মামলায় বগুড়ায় ৪৬, ময়মনসিংহের চার জেলা থেকে ৩৩, নড়াইলে ১০, সিরাজগঞ্জে ১০, রাজশাহীর বাঘায় ১০, দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ৫, যশোরে ৪ এবং ঝালকাঠির নলছিটি, নওগাঁর রানীনগর, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, ফরিদপুরে একজন করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজশাহীতে আটক করা হয় মাদারল্যান্ড ইনফার্টিলিটি সেন্টার অ্যান্ড হাসপাতালের মালিক ডা. ফাতেমা সিদ্দিকাকে। তিনি জামায়াতের বড় অর্থদাতা বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র। আটকের কারণ জানানো হয়নি।এ ছাড়া র‌্যাব জানিয়েছে, গতকাল রাজধানী থেকে তিন, বরগুনার গৌড়ীচন্না থেকে এক, কিশোরগঞ্জের বৌলাই থেকে এক, ময়মনসিংহ সদর এলাকা থেকে এক, বগুড়ায় এক, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও জালালাবাদ থেকে দুই, কক্সবাজার সদর ও কলাতলী এলাকা থেকে দুই, সিলেটের আম্বারখানা থেকে এক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে দুই, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর থেকে দু’জনসহ মোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। (প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধিরা)

Leave A Reply

Your email address will not be published.