বিশেষ প্রতিবেদকঃ খোঁজ মিলছে না আলোচিত ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর। শোনা যাচ্ছে, তিনি পরিবারসহ বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। গেল সপ্তাহের মাঝামাঝিতে আগে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে পরে মোকাম্মেল হক নিজেও নিরুদ্দেশ হন।দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সোমবার দুপুরেই স্ত্রী নাজনীন আকতার দুই ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বাসা ছাড়েন মোকাম্মেল হক। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আলোচিত এই ব্যাংকার নিজেও অনেকটা নীরবে বাসা থেকে একা বের হয়ে যান। এরপর থেকে মোকাম্মেল হকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকের পরিচালকদের চোখে তিনি এখন নিখোঁজ। বনানীতে তার বাসার নিচে পড়ে রয়েছে দুটি দামি গাড়ি। মোকাম্মেল হক চৌধুরীর বাসভবন ও ইউনিয়ন ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে আর দেখা যায়নি মোকাম্মেল হক চৌধুরীকে। বুধবার তিনি অফিসের কাজেও যোগ দেননি। ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালকেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বিষয়টি জানার পর বুধবার রাতেই উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শফিউদ্দিন আহমেদকে এমডির চলতি দায়িত্ব দিয়েছেন।জানা গেছে, বনানী থানার কাছাকাছি একটি বহুতল ভবনে নিজের কেনা ২ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকতেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। তার দুই ছেলে-মেয়েই স্কুলপড়ুয়া। মোকাম্মেল হক নিজে ব্যবহার করতেন টয়োটার প্রাডো মডেলের একটি গাড়ি। পরিবারের সদস্যদের জন্য ছিল একটি মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়ি। ভবনে কর্মরত নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে জানা গেল, তাঁর বাসায় বাইরের লোকজন তেমন একটা আসতেন না। তবে মাঝেধ্যে মোকাম্মেল হক চৌধুরীর শ্যালক ও শাশুড়ি আসতেন।ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, গত মঙ্গলবার সর্বশেষ বার ব্যাংকে গিয়েছিলেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। তবে বেশি সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। বিকেলের দিকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য পরিচয় দেওয়া কিছু ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি ব্যাংক ছেড়ে চলে যান।এদিকে, গত বুধবার সকালে ব্যাংকে না যাওয়ায় মোকাম্মেল হক চৌধুরীর খোঁজ নিতে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাসায় পাঠান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মো. ফরিদউদ্দীন আহমদ। এরপর মোবাইল বন্ধ থাকায় ও তাকে বাসায় না পাওয়ায় এমডি ‘নিখোঁজ’ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানান চেয়ারম্যান। সেদিনই গভর্নরের সঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাংক পর্ষদের পূর্বনির্ধারিত সভা ছিল। সেখানেই জানানো হয়, সভায় যোগ দেওয়ার জন্য এমডিকে পাওয়া যায়নি। এরপর বুধবার রাতেই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভা ডেকে ডিএমডি শফিউদ্দিন আহমেদকে এমডির চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়।ইউনিয়ন ব্যাংকের দুজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, মোকাম্মেল হক পরিবারসহ বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন বলে তারা শুনেছেন। এ ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য।আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৭ আগস্ট এস আলম গ্রুপ মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অভিযোগ রয়েছে, নতুন পর্ষদের সদস্যরা এমডি মোকাম্মেল হকের অসহযোগিতার কারণে ব্যাংকটির অবস্থার বিষয়ে সঠিক তথ্যও পাননি। এর আগে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি রহস্যময় হিসাব থেকে নগদ টাকা উত্তোলন ও মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নিজের হিসাব থেকে তার গচ্ছিত পুরো অর্থ তুলে নেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।অভিযোগ রয়েছে, এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোকাম্মেল হক চৌধুরী দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অপরাধ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকটির মোট ঋণের মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশই নিয়েছে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে কাল্পনিক লেনদেনের মাধ্যমে, যার বিপরীতে জামানতও নেই। আবার ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে বলে ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়েছিল, খেলাপি ঋণের হার ৪ শতাংশের কম।এর পাশাপাশি মোকাম্মেল হক চৌধুরী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগর প্রধান হারুন অর রশীদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। এ কারণে ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত টাকার হিসাবে গরমিলসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। যদিও এ নিয়ে মোকাম্মেল হক চৌধুরী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।