সাতক্ষীরা প্রতিনিধি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার ও টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালু না হওয়ায় কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়) সরকারের কোটি কোটি টাকা ভেস্তে যেতে বসেছে। বর্তমানে টিআরএম কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় কপোতাক্ষ নদ আবারও পলি জমে ভরাট হচ্ছে। খনন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩১ কোটি সাত লাখ টাকার কাজ চলছে শম্বুকগতিতে।কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে ২০২০ সালের আগস্টে চার বছর মেয়াদি ‘কপোতাক্ষ নদ খনন দ্বিতীয় পর্যায়’ প্রকল্পে ৫৩১ কোটি সাত লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।নদ খননের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটির মূল কাজ হলো- পাখিমারা বিলে পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার ও টিআরএম কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং নদী খনন। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে খননকাজ দুই বছর অতিবাহিত হলেও অদ্যাবধি টিআরএম বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। পাখিমারা বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার, জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে টিআরএম কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে নদী পুনঃখনন কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষের প্রাণের দাবি।জানা গেছে, জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক উদ্যোগে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প ( প্রথম পর্যায়)’ নামে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১১ সালের জুলাই মাসে, আর সমাপ্ত হয় ২০১৭ সালের জুন মাসে। কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পটির প্রধান দুটি বিষয় ছিল- ৯০ কিলোমিটার নদী খনন এবং তালা উপজেলার জালালপুর, খেশরা ও মাগুরা ইউনিয়নে অবস্থিত পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন। প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন হওয়ায় বিশাল কপোতাক্ষ অববাহিকা জলাবদ্ধমুক্ত হয়েছে, উপকৃত হয়েছে কপোতাক্ষ পাড়ের ১৫ লাখ অধিবাসী।
প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল কাজ হলো পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার ও টিআরএম কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। এ জন্য পাখিমারা বিলের কৃষকদের ১৫৫৬.৬২ একর জমি দুই বছরের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও অদ্যাবধি কোনো জমির মালিক তা পাননি। ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় বেশির ভাগ জমির মালিকরা তাদের জমি দখল করে চাষাবাদ ও মাছ চাষ শুরু করায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় জনগণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমির ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে উক্ত বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কারপূর্বক টিআরএম কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে নদী পুনঃখননের দাবি জানিয়েছেন।এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে জোয়ারের পানির চাপে পাখিমারা বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে জালালপুর ও মাগুরা ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। মানুষের ঘরবাড়িতে পানি উঠে যায়। ভেসে যায় ফসলক্ষেত, মৎস্য খামার এবং চলাচলের রাস্তা। পেরিফেরিয়াল বাঁধ পরিণত হয় ভগ্নদশায়। এমতাবস্থায় প্রকল্পের স্বার্থে ও জনগণের দাবির মুখে পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কারের লক্ষ্যে বিগত ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলে টিআরএম বিলের সংযোগ খালের মুখ বাঁধ দিয়ে টিআরএম বন্ধ করা হয়, যা এখনো বন্ধ রয়েছে। বাঁধ মেরামতের টাকা বরাদ্দ হলেও জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ চালু না করার কারণে জনগণের চাপের মুখে পেরিফেরিয়াল বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তিতে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির কারণে জমির মালিকরা অতিষ্ঠ।
টিআরএম বিল অধিবাসীদের মতে, পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়নের ফলে বিশাল কপোতাক্ষ অববাহিকার মানুষ উপকৃত হলেও তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও ভোগান্তি লাঘবে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটি চলমান রয়েছে এবং ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর অতিবাহিত হতে চলেছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত টিআরএম বিল অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। এ সময় পাখিমারা টিআরএম বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার, ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে টিআরএম কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে নদী পুনঃখননের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ সব মহলের কাছে পানি কমিটি, সুশীল সমাজ, সর্বস্তরের জনগণ জোর দাবি জানায়।এ বিষয়ে জালালপুর, খেশরা, মাগুরা ইউপির চেয়ারম্যানরা এ প্রতিবেদককে জানান, পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়নে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও ঠিকমতো ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় জমির মালিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ বিষয়ে তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, কপোতাক্ষ খননের প্রথম পর্যায়ে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩১ কোটি সাত লাখ টাকা সরকার বরাদ্দ দিলেও ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিআরএম এলাকার জমির মালিকরা প্রথম দুই বছরের ক্ষতিপূরণ পেলেও পরবর্তী সময়ে আর পাননি। ডিসি অফিসে খোঁজ নিয়ে যানা যায়, দ্বিতীয় ফেইজের টাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড জমা না দেওয়ায় জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারছেন না। এহেন অবস্থা চলতে থাকলে কপোতাক্ষ নদ খননে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাবে বলে মনে করেন তিনি।যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তৌহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, দ্বিতীয় ফেইজে নদীখনন সাতক্ষীরা অংশে প্রায় ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ায় কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। টিআরএম এলাকার ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে তিনি বলেন, রেভিনিউ খাতে টাকা ধরা আছে। কৃষকরা ডিসি অফিস থেকে পর্যায়ক্রমে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে যাবেন। তবে দ্বিতীয় ফেইজে দুই বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও টিআরএম কেন চালু হয়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৃষকরা ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় সেখানে কোনো কার্যক্রম করা যাচ্ছে না।