বিশেষ প্রতিনিধি সরকারের শেষ সময়ে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ এমপিওভুক্ত হলো ৯১টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩৫, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৫, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ২৩ ও ডিগ্রি (পাস) কলেজ সাতটি।গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক-৩ শাখার পৃথক পাঁচটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া গত ১৪ আগস্ট চাঁদপুরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নির্বাচনী এলাকার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।এর আগে গত বছরের ৬ জুলাই সারাদেশের ২ হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। সে সময়ে বাদ পড়া কিছু প্রতিষ্ঠান এক মাসের মধ্যে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আপিল করেছিল। যাচাই-বাছাই শেষে এ বছরের ১২ জানুয়ারি আপিলের ফল প্রকাশ করা হয়। আপিলে আরও ২২৩টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এ মুহূতে সারাদেশে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সাড়ে ৪ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মান্থলি পে-অর্ডারভুক্ত (এমপিও) হওয়ার আশায় রয়েছে। এর মধ্য থেকে মাত্র ৯১টি সরকারের বিশেষ বিবেচনায় এলো।
‘নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী পরিষদে’র আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো. দবিরুল ইসলাম বলেন, সাড়ে ৪ হাজার প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় না নিয়ে মাত্র ৯১টিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া দুঃখজনক। আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছিলাম, এমপিও নীতিমালার শর্তাবলি পুনর্বিবেচনা করে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া সব নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে এমপিওভুক্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দুই দশক বা এরও বেশি সময় বেতনহীন অবস্থয় থাকায় মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক কর্মচারীদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু ও যৌক্তিক নীতিমালার শর্তও তাদের জন্য পূরণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নন-এমপিও কলেজের ২০২১ সালের এমপিও নীতিমালার শর্তাবলি পূরণ করে এমপিওভুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তদবিরে অনেক কিছুই হচ্ছে।গতকাল এমপিওভুক্তি পাওয়া খুলনা মহানগরীর খুলনা আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার জানান, গত বছর এমপিওভুক্ত হতে না পেরে তারা আপিল করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে বলেছিলেন স্থানীয় মেথরপট্টির সুইপারের সন্তানরা তার কলেজে লেখপড়া করে। তারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তিনি বলেন, এমপিভুক্তির নীতিমালার ২২ ধারায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, দুর্গম এলাকা, নারী শিক্ষা ইত্যাদি বিবেচনায় কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি পেতে পারে। তারাও সে সুযোগটিই নিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০০০ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩ বছর ধরে কষ্ট করেছেন। এবার এমপিও পেলেন।
শর্তসাপেক্ষে এমপিও
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার (এমপিও) সরকারি অংশ শর্তসাপেক্ষে দেবে সরকার। শর্তগুলো হচ্ছে– শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি ও শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিষয়াদি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী কার্যকর হবে। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা নিয়োগকালীন বিধি-বিধান ও সংশ্লিষ্ট পরিপত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য হবে। নিবন্ধন প্রথা চালু হওয়ার আগে বিধিসম্মতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির সুযোগ পাবেন। কিন্তু পরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য অবশ্যই নিবন্ধন সনদ প্রযোজ্য হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বিবেচিত হয়েছে, তার মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অনুযায়ী কাম্য যোগ্যতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে সেসব প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করা হবে এবং পরে কাম্য যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে স্থগিত এমপিও অবমুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।যে তথ্যের আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে কোনো তথ্য ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হলে তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রদানকৃত তথ্যের সঠিকতা সাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এমপিওভুক্তির আদেশ কার্যকর করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির এ আদেশ গতকাল মঙ্গলবার থেকেই কার্যকর করা হয়েছে।
নির্বাচনী ট্রাম্পকার্ড?
সংশ্লিষ্ট অনেকেই অভিযোগ করছেন, হঠাৎ করেই বিশেষ বিবেচনায় ৯১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা সরকারের স্রেফ নির্বাচনী ট্রাম্পকার্ড। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিও নীতিমালার শর্ত পূরণ না করলেও মন্ত্রী-এমপিদের বিশেষ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’য় এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার প্রয়োজন মনে করলে যে কোনো সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে পারে। এতে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।হঠাৎ করেই, এমনকি কোনো আবেদন গ্রহণ ছাড়াই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ঘটনায় চরম বিস্ময় প্রকাশ করেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাধারণত দুই-তিন বছর পরপর এমপিওভুক্ত করার আবেদন নেওয়া হয়। এটিই প্রচলিত নিয়ম; কিন্তু এবার ঘটেছে উল্টোটা। এবারের এমপিওভুক্তিতে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য বিষয় ছিল।বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষক সংগঠনগুলোর নেতারা মনে করছেন, বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ফলে ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীনরা এটি নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করবে।