LastNews24
Online News Paper In Bangladesh

একটা আক্ষেপ ছিল এ টি এম শামসুজ্জামানের

বিনোদন ডেস্ক   ‘সারা জীবন শুধু টাকার জন্যই অভিনয় করে গেছি। এতে সৃষ্টিশীলতা ছিল না, মাথায় সব সময় খাওয়া-পরার চিন্তা ছিল। যদি আরেক জনম পেতাম, তাহলে আবারও অভিনয়জগতে আসতাম। সে জীবনে পেটের চিন্তা করতে হতো না, নিজেকে উজাড় করে মনের মতো চরিত্রে অভিনয় করতাম।’ আক্ষেপ নিয়ে এ কথা বলেছিলেন বরেণ্য অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। তাঁর পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। তিনি একজন কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা পাওয়ায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করে অঝোরে কেঁদেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো এই পুরস্কারের যোগ্য না। নিজেরই লজ্জা লাগবে এই পুরস্কার নিতে।’ জনপ্রিয় এ অভিনেতার জন্মদিন আজ। ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এ টি এম শামসুজ্জামান। ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের তৃতীয় তলার বিশেষ কেবিন-৩২২। এখানে শুয়ে ছিলেন এ টি এম শামসুজ্জামান। জ্বর ছিল। শ্বাসকষ্ট ছিল সামান্য। পরিবারের অন্য সদস্যের অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলি। সেদিন কথা প্রসঙ্গে জানতে চাই, ‘চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন, কেমন লাগছে? প্রশ্ন শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে যান প্রবীণ এই অভিনেতা। আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি যা করেছি, এটা হিসাবের মধ্যে পড়ে না। আমি তো সারা জীবন ভাঁড়ামিই করে গেলাম। অভাব ছিল। অভিনয় করে পেট চালাতে হয়েছে। এ জন্য মনের মতো চরিত্রে অভিনয় করতে পারিনি। বড়লোকের ছেলে হলে আমি আমার মনের মতো অভিনয় করতে পারতাম। কিন্তু সেটা পারিনি। ভাঁড়ামিটাই করে গেছি।’ নিজের অভিনীত ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘বিরহ ব্যথা’ চলচ্চিত্রগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছিলাম এমন সাহিত্যনির্ভর গল্পের চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে। দু-একটি করেছি বটে, তবে তেমন বেশি চলচ্চিত্র পাইনি। দর্শক শুধু আমার ভাঁড়ামিই দেখে গেছে।’ শেষ জীবনটা কষ্ট কেটেছে এ টি এম শামসুজ্জামানের। প্রায় দুই বছর নানা শারীরিক জটিলতা ছিল। অভিনয় থেকে দীর্ঘদিন তিনি দূরে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত অভিনয় করেন। আগে কখনো অভিনয় থেকে এত দীর্ঘ বিরতি নেননি। তাই এ নিয়ে মন খারাপ ছিল। অভিনয়ের মানুষ তিনি, অভিনয় ছাড়া থাকতে পারেন না। এফডিসি, লাইট, ক্যামেরার সঙ্গ এবং সহকর্মীদের সঙ্গ ছাড়া তাঁর ভালো লাগে না। এসব নিয়েও আক্ষেপ ছিল তাঁর। আগে ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই নিয়মিত খবর নিলেও শেষ দিকে কোনো উপলক্ষ ছাড়া কেউ তেমন একটা যোগাযোগ করতেন না। মানুষ পেলে এ টি এম শামসুজ্জামান কথা বলতেন খুব। মন খুলে কথা বলতেন। নানা সময়ের স্মৃতিচারণা করতেন। সেদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে এ টি এম শামসুজ্জামান বলেছিলেন, প্রথম জীবনে তিনি হতে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক। স্মৃতিচারণা করে তিনি জানান, স্কুলের সাময়িকীতে ‘অবহেলা’ শিরোনামে একটি ছোটগল্প ছাপা হয়েছিল। গল্পটি পড়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রশংসা করেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁকে বিভিন্ন সময়ে লেখার ব্যাপারে পরামর্শদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সে সময়ের বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের অনুপ্রেরণায় তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এসেছেন। তিনি জানান, সরাসরি শিক্ষক হিসেবে তিনি শওকত আলী, অজিত কুমার গুহর সান্নিধ্য পেয়েছেন। ১৯৬৫ সাল থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। প্রথম অভিনীত ছবি ‘ন্যায়ী জিন্দেগি’, যা শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। এ সময় এ টি এম শামসুজ্জামান ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ১৯৭৪ সালে তিনি আমজাদ হোসেন পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নয়নমণি’তে অভিনয়ের সুযোগ পান। মন্দ লোকের চরিত্রে অভিনয় করে এ টি এম শামসুজ্জামান তাঁর অভিনয়জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ এ পৌঁছে যান, ছবিটিও দর্শকপ্রিয়তা পায়। ফলে, পরিচালকেরাও তাঁকে একের পর এক খলনায়ক চরিত্রে নিতে থাকেন।একসময় নিজেকে ভাঙেন এ টি এম শামসুজ্জামান। এ টি এম শামসুজ্জামান ২০০৯ সালে প্রথম পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটিকে নিয়ে ‘এবাদত’ নামের ছবিটি। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘এবাদত’ একই সালে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অসংখ্য নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। তবে এ পর্যন্ত শতাধিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার এবং তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান আজও তাঁর শ্রেষ্ঠ অভিনয়টি করতে পারেননি বলে আফসোস করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এমন অভিনয় করবেন, যাঁর জন্য বাংলাদেশের দর্শক তাঁকে সারা জীবন মনে রাখবে। তাঁর আশা ছিল, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার অভিনয়জগতে ফিরবেন। মনের মতো চরিত্রে অভিনয় করবেন। কিন্তু মহাকাল তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়নি। তিনি চলে গেছেন অনতিক্রমণীয় দূরত্বে। 

About Author

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More