বর্তমানে বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরের দাম ১৮০ থেকে শুরু করে এক হাজার ৭০০ টাকা। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আম্বার খেজুরের গড় দাম এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা, মরিয়ম খেজুরের দাম এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, আজওয়া খেজুরের দাম এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
বাজারে সাধারণ মানের খেজুরের মধ্যে প্রতি কেজি নাগা খেজুর ৪৮০ থেকে ৫৪০ টাকা, জেহাদি ও খুরমা খেজুরের দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।
পাঁচ বছরে দাম বেড়েছে ৮ গুণ : গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেজুরের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, পাঁচ বছর আগে প্রতি কেজি জেহাদি খেজুর বিক্রি হতো ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।বর্তমানে এই খেজুরের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। সে হিসাবে এই খেজুরের দাম বেড়েছে আট গুণেরও বেশি।
খেজুর আমদানিতে শুল্ককর : শুল্ক ছাড় দেওয়ার পর এখন খেজুর আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের শুল্ককরের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮.৭০ শতাংশ। এর আগে খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে শুল্ক দিতে হতো ৬৩.৬০ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে এই শুল্ক দিতে হয়েছে। এর মধ্যে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ২৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ১০ শতাংশ, আরডি ৩ শতাংশ এবং এটি ৫ শতাংশ।
এই উচ্চ শুল্কহারের পাশাপাশি আজওয়া, মরিয়ম, মেডজুল, মাবরুর ও রেফার কনটেইনারে আমদানি করা সব ধরনের খেজুর শুল্কায়নে কেজিপ্রতি এক থেকে চার ডলার পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয়। এতে ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দাম থাকছে নাগালের বাইরে। বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছরই অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
তবে কয়েকটি দোকানদারকে জরিমানা করা ছাড়া অভিযানের তেমন কোনো দৃশ্যত সফলতা নেই। শুল্ক ছাড়ও দেওয়া হয় রমজান মাস শুরুর কয়েক দিন আগে। সে হিসাবে আমদানিকারকরা রেয়াতি দরে খেজুর কিনলেও তা বাজারে আসে রমজান মাসের পর। শুল্ক ছাড় দিলেও সেই প্রভাব বাজারে পড়ে না।
এবার সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে রমজান শুরুর বেশ আগেই অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে শুল্ক ছাড় দিতে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এনবিআরকে পাঠানো চিঠিতে উচ্চ শুল্ক হার ও শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কমিশন। তারা বলেছে, কনটেইনারে আমদানি করা সব ধরনের খেজুর শুল্কায়নে কেজিপ্রতি এক থেকে চার ডলার পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয়। এই শুল্কায়ন প্রক্রিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) শুল্ক মূল্যবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণও ত্রুটিপূর্ণ।
আমদানির উৎস ও পরিমাণ: সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই খেজুর উৎপাদন হয় এবং তাদের অনেকে রপ্তানিও করে। মূলত সৌদি আরব, আরব আমিরাত, তিউনিশিয়া, মিসর, জর্দান, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান থেকে খেজুর আমদানি করা হয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে খেজুর আমদানি করা হয়েছে ৮৬ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৯১০ মেট্রিক টনে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) খেজুর আমদানি হয়েছে নামমাত্র। এ সময় মাত্র ২৮৯ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে। সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে খেজুর আমদানির পরিমাণ কমছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাব : আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষে খেজুরের আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম কর কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। রোজায় খেজুরের দাম সহনীয় রাখতে কমিশনের সুপারিশ, খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ থেকে ১৫ শতাংশ এবং অগ্রিম কর ১০ থেকে ৩ শতাংশ করা হোক। এ ছাড়া আগাম কর (৫ শতাংশ) ৩১ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সময়ের জন্য অব্যাহতির সুপারিশ কমিশনের।
সেই সঙ্গে গত বছরের শুল্ক ছাড়ের প্রসঙ্গে টেনে কমিশন বলেছে, ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এসআরও জারি করে খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। তবে রমজান শুরুর ঠিক কয়েক দিন আগে এই সুযোগ দেওয়ায় তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। তাই রমজান শুরুর তিন মাস আগে শুল্ক ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। যাতে রেয়াতি সুবিধাপ্রাপ্ত খেজুরের সরবরাহ বাজারে থাকে।
সরবরাহ বৃদ্ধির প্রত্যাশা এনবিআরের : এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান দায়িত্বে আসার পর বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে চাল, ভোজ্য তেল, ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও কীটনাশক আমদানির ওপর রাজস্ব ছাড় দিয়েছেন। যদিও এর সরাসরি কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে আন্তরিকতা দেখানো হয়েছে। এবার খেজুর আমদানিতেও শুল্ককর ছাড় দিয়েছে এনবিআর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সাংবাদিককে বলেন, রমজানের ঠিক আগ মুহূর্তে শুল্ক ছাড় দিলে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ে না। এমন বাস্তবতায় আগে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে খেজুরের আমদানি বাড়ার পাশাপাশি বাজারে খেজুরের সরবরাহ বাড়বে। সেই সঙ্গে বাজারে দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
মানুষের ভাবনায় ন্যায্যমূল্য : খেজুর কিনতে আসা একাধিক ক্রেতার সঙ্গে আলাপ করেছেন এই প্রতিবেদক। সেখানে শুল্ক ছাড়, সিন্ডিকেট প্রতিরোধ, বাজার মনিটরিংসহ সরকারের হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে যত কৌশল আছে তা প্রয়োগ করে বাজারে দাম কমানোর দাবি করেছেন তাঁরা। রাজধানীর কচুক্ষেত বাজারের ক্রেতা মারুফ বলেন, খেজুরের দাম সারা বছরই বাড়তি। তবে প্রতিবছর রমজান মাসে তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। এবার যেন বাজারে কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয় এবং ন্যায্যমূল্যে খেজুর কিনতে পারি সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।